জামিয়া মারকাযুদ দুরুস আল ইসলামিয়া। মাসিক আদর্শ নারীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, দেশবরেণ্য আলেমে দ্বীন মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদীর হাত ধরে ২০২০ সালের রমযান মাসে স্থাপিত একটি কওমি ধারার মাদরাসা। সে বছর রমযানে অনলাইনে ২৫ দিন ব্যাপী বয়স্ক কুরআন শিক্ষা কোর্সের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা। করোনার প্রকোপ তখন চারিদিকে, লকডাউন চলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ। মসজিদগুলো ছিল মুসল্লি-শূন্য, তালাবদ্ধ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হত সবখানে। জনসমাবেশ বা সমাগম ছিল নিষিদ্ধ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সন্ধ্যা নামতেই বন্ধ করে দিতে হত। সেই প্রতিকূল সময়টাতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাসায় বসেই অনলাইনে পড়াশোনার সিস্টেম চালু করার প্রয়াস নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কঠিন সেই করোনাকালে এক ঝাঁক তরুণ-বরুণ শিক্ষার্থী সঙ্গী হয়েছিলেন আমাদের। অনলাইন সেই যাত্রাটা শুরু হয়ে এখনও চলমান রয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকভাবে দাওরায়ে হাদীস ফারেগীন, যারা ইলমে ফিকহে তাফাক্কুহ অর্জনে ইচ্ছুক, তাদের জন্যে তাখাসসুস ফিল ফিক্বহ ওয়াল ইফতা কোর্স এবং কর্মব্যস্ত জেনারেল শিক্ষিত, যারা কুরআন পড়তে জানতেন না অথবা দ্বীনী ইলম অর্জনে ইচ্ছুক ছিলেন, তাদের জন্যে ইলমে দ্বীন নাইট কোর্স খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
অফলাইন ইফতা চালু না করে অনলাইনে করার কারণ হচ্ছে, মদিনা প্রবাসী মাওলানা ইয়াহয়া ইবনে রুহুল কিস্তসহ অনেক তালিবে ইলম নির্ভরযোগ্য একটি ইফতা বিভাগের তালাশে ছিলেন দীর্ঘদিন যাবত। তখন সৌদিসহ বাংলাদেশের সকল ইফতা বিভাগ করোনার কারণে বন্ধ ছিল। ফলে তারা আমাদের কাছে বারবার আবেদন জানাচ্ছিলেন কোর্সটি চালু করবার জন্যে। যেহেতু তারা বিভিন্ন দেশ ও জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, নিজ আবাস অথবা কর্মস্থল ছেড়ে মাদরাসায় এসে আবাসিক পড়াশোনা করাটা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবার করোনার কারণে আবাসিক সিস্টেমে মাদরাসা খোলাও সম্ভব হচ্ছিল না, ফলে আমরা নববী ইলম চর্চা ও দ্বীনি ইলমের ধারা চালু রাখার উদ্দেশে এবং শিক্ষার্থীদের আব্দার রাখার প্রেক্ষিতে মারকাযুদ দুরুস অনলাইন ইফতা বিভাগের সূচনা করি।
প্রাথমিকভাবে শিক্ষক হিসেবে আমাদের মারকাযে খিদমত শুরু করেন ৫ জন আলেমে দ্বীন:
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী, মুফতি সাঈদ আল হাসান, মুফতি আব্দুর রহমান ফাইয়াজ, মুফতি উবায়দুর রহমান হাম্মাদ, মুফতি লুকমান হাকীম প্রমুখ।
পরবর্তীতে আরও ৩ জন যুক্ত হন, মুফতি আরিফ জাব্বার কাসেমী, মুফতি আমীনুর রশিদ মামনুন, মুফতি কামরুল হাসান প্রমুখ।
শুরু থেকে আসাতিযায়ে কিরামের অক্লান্ত মেহনত এবং আল্লাহর রহমত আমাদের সঙ্গী হওয়ায় মারকাযের ১ম ও ২য় বর্ষের সফল সমাপ্তি ঘটেছে। বর্তমানে মারকায ৩য় বর্ষে উপনীত।
অনলাইন মাদরাসার প্রতি মানুষের যে বিরূপ ধারণা রয়েছে, বিশেষ করে ইফতার প্রতি, সেটি নির্মূল করতে মারকায সর্বদাই সচেষ্ট। মারকাযুদ দুরুস গতানুগতিক কিছু অফলাইন ইফতার চেয়েও আলাদা। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন এবং সরকারী ছুটি ছাড়া সারা বছর মারকাযের দারসী কার্যক্রম চালু রাখা হয়। মারকাযের সকল উস্তায সারা বছর প্রতিটি দারসের ইহতিমাম করতে সচেষ্ট থাকেন। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অফলাইনের চেয়ে অনলাইনে বেশি গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। প্রতিদিন প্রতিটি দারসে শিক্ষার্থীদের হাজিরা নেয়া হয় এবং সারা বছর উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে পুরস্কার প্রদান করা হয়। হাজিরার উপর পরীক্ষায় এক্সট্রা নাম্বারও যোগ করা হয়। সকল ছাত্রদের হাজিরা অনলাইন ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে। টানা অনুপস্থিতি পাওয়া গেলে ভর্তি বাতিল করা হয়। মারকাযের সকল পরীক্ষা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার পূর্ণ সময়টা ভিডিওর মাধ্যমে মনিটরিং করা হয়। কোন ধরনের খেয়ানত যাতে না হতে পারে, সে ব্যাপারে আসাতিযায়ে কিরাম সজাগ দৃষ্টি রাখেন। পরীক্ষা শেষ হলে উত্তরপত্র মারকাযে কুরিয়ার করতে হয়। আসাতিযায়ে কিরাম সরাসরি খাতা দেখে স্বহস্তে নাম্বার প্রদান করেন। সারা বছর ৩টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বার্ষিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল অর্জন না করতে পারলে সনদ, মার্কশিট স্থগিত করা হয়। টাকার বিনিময়ে সনদ প্রদান করা হয় না। এমনকি ভর্তি পরীক্ষায় পাশ না করলে ভর্তিও নেয়া হয় না। একমাত্র যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হয়। নিয়মিত মুতালাআ ও তামরীনে ফতওয়ার ব্যাপারেও মারকায অত্যন্ত যত্নবান। সারা বছর শুধু তামরীনে ফতওয়ার জন্যে আলাদা গ্রুপ বানিয়ে মেহনত করানো হয়। তামরীনের নিয়ম-কানুন আত্মস্থ করিয়ে ১০টি ধাপে ফতওয়া অনুশীলনী শিক্ষাদান করা হয়। অনলাইন হলেও চেষ্টা করা হয় অফলাইনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান করতে।
ধীরে ধীরে আমরা দারসে নেযামির পাশাপাশি তাফসীর, আদব ইত্যাদি তাখাসসুসাত বিভাগ খোলার ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ তাউফিক দিন।
মারকাযুদ দুরুস প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুসলিম সমাজে কুরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ তা’লীম-তারবিয়্যত, ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনের ব্যাপক প্রচার, আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা প্রচার-প্রসার, ইসলামের সঠিক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সংরক্ষণ এবং সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে আসছে।
প্রতি বছর জামিয়া থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে বিরাট সংখ্যক ছাত্রবৃন্দ ফিকহে ইসলামীতে মাহারাত ও গভীর জ্ঞান অর্জন করতঃ দেশ ও জাতির ব্যাপক দ্বীনি খিদমত ও উপকারে আত্মনিয়োগ করে থাকে।
আমরা দেশ-বিরোধী বা রাষ্ট্রবিরোধী কোন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেও জড়িত নই এবং আমাদের শিক্ষার্থীরাও যাতে জড়িত না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে।
সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী, আল্লাহ যেন মারকাযুদ দুরুস এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে কবুল করে নেন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।